শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৩

মগজ জুড়ে শব আর শহরের মৃতদেহ



একটি ছোট পিড়ির উপর এক প্যাকেট মস্তিষ্ক ,
তাতে রাস্তার ধারের ভাজা ডালমুট আর ঘামেভেজা রুমালের নিঃশ্বাস ,
লাল আগুনের উপর কালো কড়াইতে তপ্ত বালির বুকে ,
বাদামের দলের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর তোমার আর তোমার প্রেমিকার
নরম হাতের আঙ্গুল ওদের আবরণকে বিদীর্ণ করে নোংরা করে তোমাদের জুতার তল ।
তোমাদের প্রেম , কাম, স্বার্থ আর স্বপ্নের বুলি আউড়ে যাওয়া চোয়ালের ভেতর ভেঙ্গে
ক্লান্ত ক্লান্ত হয় আর মিশে যায় তোমাদের লালারসে ।

একটি ছোট টুলের উপরে এক গ্লাস মস্তিষ্ক ,
এক কোণায় সিগারেটের আ্যশ-ট্রে , তাতে কোন বৃদ্ধ ফুসফুসের যুবকের
মৃত ফুসফুসের কণা , তারও পাশে তিন মাস আগের এক রংচটা ম্যাগাজিন ,
সুন্দরী মডেল আর চটুল প্রেমের সস্তা গল্পের পরিহাস ,
মেঝেতে এক সিঙ্গারার ঠোঙ্গা , উচ্চ মাধ্যমিক সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের পৃষ্ঠা ,
আর তোমার আর তোমার প্রেমিকার এবং তোমাদের অভূমিষ্ঠ সন্তানের এথিক্স
এভাবেই ঘুরতে থাকে ফি- শতাব্দী , তোমাদের ঔরসে আর জঠরে ।

একটি ছোট টেবিলের উপর এক প্লেট মস্তিষ্ক ,
তার পাশেই তোমার পরিবারের এঁটো খাবারের বাসন ,
তরকারির ঝোল লেগে সাদা কাপড়টা ভীষণ নোংরা আর তোমার
দাঁতের ফাঁকে আটকে মাংসের এক কণা । তোমার বউয়ের মুখে দামী প্রসাধনী প্রলেপ ,
তোমার ছেলের বালিশের তলে এক প্যাকেট সিগারেট আর ...
তোমার হাতের তেলো এখন দশ ইঞ্চি পুরু, আর আমার সস্তা পাঁচ টাকার কলম ,
ভাঙবেই - তার সন্দেহ নেই কিংবা এক কাপ ব্ল্যাক কফি আর রাস্তার পাশের টঙের চা ,
যেই হিসাবগুলো আমাদের আর তোমাদের কখনই মিলবে না ।

একটি ছোট বালিশের উপর রাখা এক মাথা মস্তিষ্ক ,
তার নিউরনে অমানুষের জন্ম আর মানুষের মৃত্যু আর নগ্ন শহরের ধ্বংস স্তূপের
শেষ বাড়ির শবযাত্রা , তার একরাশ ঘিলু কিলবিল করে উঠে প্যাচপ্যাচে কাদায় ,
আর মার্সিডিজের ধাক্কায় থেঁতলে পিষে থাকে সরকারি ওই বড় রাস্তায় ।
আমার মগজ জুড়ে শব আর শহরের মৃতদেহ , আর কচি কচি ঘিলুময়
বিযোজক ব্যাকটেরিয়ার আর্তনাদ আর হাহাকার !

বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৩

বিপ্রতীপ



যতটুকু বছরের প্রথম বৃষ্টিভেজা জলকে দুহাতে আলিঙ্গন করে পাওয়া ,
তারও বেশি চোরাবালির টানে হারিয়ে ফেলা ।
যতখানি আলো , তার আরও বেশি অন্ধকার ছায়া ,
যতখানি আসল ,তারে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে কায়া আর মায়া ।

যতটুকু সকালের স্নিগ্ধ আলোকে পরম মমতায় দু'গালে চেপে ধরা ,
তারও বেশি মধ্যাহ্নের সত্যি উত্তাপকে ভ্রূকুটিতে দূরে ঠেলে দেওয়া ।
যতখানি সুর , তার মাঝেও বাজে অসুর ,
যতখানি হলুদ , তার মাঝেও থাকে সরষে ফুলের ভূত ।

যতটুকু বসন্তের বাতাসকে বুকে আগলে রাখা,
তারও বেশি শীতের কুয়াশায় নিজেকে হারাতে না দেওয়া ।
যতখানি ঠিক , তার আরও বেশি ভুল ,
যতখানি স্মৃতি , তার নিঃস্ব একটি ফুল ।

যতটুকু অর্ধমাসের সঙ্গী চন্দ্রের প্রতীক্ষা ,
তারও বেশি বার মাসের সাথী শুকতারাকে না চেনা ।
যতখানি ফাঁক , তার আরও বেশি ফাঁকি ,
যতখানি নীল , তার মাঝেও গরমিল ।

যতটুকু রঙিন স্বপ্নকে দিবারাত্রির কাব্য করে নেওয়া ,
তারও বেশি অতীতের দুঃস্বপ্ন থেকে পালিয়ে বাঁচা ।
যতখানি ঘর , তার থেকেও বেশি বেঘর ,
যতখানি গড়ে নদী , ভাঙ্গে তারও বেশি ।

যতখানি কাঁচা ঘুমকে নিবিড় ভালবাসায় জড়িয়ে ধরা ,
তারও বেশি বিক্ষিপ্ততার মাঝে ডুবে যাওয়া ।
যতখানি বাস্তব , তার থেকেও বেশি হ্যালুসিনেশন ,
যত বড় চিন্তা , তারও অসামান্য বাস্তব ।


যত ধনাত্মক , ক্রমে হয় শূন্য , সম ঋণাত্মকতায় ,
যত অসম্ভব কাব্য ভাঙ্গা -গড়া আর অসমাপ্ত সমাপ্তির আলাপিতায় ...

রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

বিষমানুষের গল্প


বিষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমার হাত আজ নীল,
মটরের খোসা ছাড়িয়ে কখনো উপবৃত্তাকার মটর দানা
তুমি খুঁজে পাবে না ।
যে গোলকধাঁধার ভুল-ভুলাইয়ায় তুমি তোমার সচেতন অতীত,
অবচেতন ভবিষ্যৎ আর অচেতন বর্তমানকে একই পাল্লায় মাপো
তার মানদণ্ডের কাঁটাটিই বাঁকা, যদিও তুমি পৃথিবীর সেই প্রথম দিন
থেকেই তা সোজা দেখছিলে তোমার ঐ বক্র উত্তল লেন্স দুটি দিয়ে ।
কখনও বৃষ্টির সেই জলধারা যা তরল হয়ে নিচে নেমে আসে
তাকে প্রবল উত্তাপের দহনে বাষ্প হয়ে মেঘের সাথে মিশে যেতে দেখনি ।
তুমি অখণ্ড আকাশ দেখতে চেয়েছিলে অথচ তোমার দৃষ্টিসীমা
খণ্ডিত ঐ দিগন্তরেখাতেই । তুমি নদীর জলের রপোলি জোড়া ইলিশ
তোমার জালে বাঁধতে চেয়েছিলে ,অথচ এক বুড়ো ধাড়ি ইঁদুরের পোক্ত
দাঁতের ধারে সেই জালের সমগ্রতা এক বিশাল শূন্যতা ।
তুমি আগুনকে বাঁধতে চেয়েছিলে একগাছি কাঁচা সুতা দিয়ে
তাতে আধপোড়া ম্যাচকাঠিগুলোই পুড়ল কেবল নতুন করে ।
সবুজ নক্ষত্র আর ছিটকে পড়া ধূমকেতুর দল চন্দ্রপ্রেমীদের হলদে
প্রেমের আঠায় আটকাতে পারে না । ভাসমান কচুরিপানার শিকড় আর
জলের তল খুঁজে পায় না । আ্যন্টিক্লকওয়াইজ ঘূর্ণনে কেবলই উন্মোচনের
শিখিয়ে দেওয়া তত্ত্ব আর তা বদলে দিয়ে বাদুড়ের দলকে সভ্যতা শেখাতে পারবে না
তুমি কখনোই ; ওরা বরাবরের মতই ঝুলবে উলটো হয়ে ।
তবু পারলে মনে করো পশ্চিমে উঠা সেই নীল সূর্য আর '' বিষ মানুষের গল্প ''
যাদের ঘূর্ণন ছিল অনির্ণেয় ... আর যারা ছিল অজস্র মৃত্যুর কেন্দ্র ।
তুমি মনে করো, আমি মনে করাচ্ছি ...

বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

শ্বেত পাথরের কথা



বহুদিন এই ঘাটে পা পড়েনি তার,
বহুদিন কথার প্রাঙ্গণ ছিল ক্ষুধার্ত ,
বহুদিন হিসেব মেলেনি ছেঁড়া খাতার অংকগুলোর,
বহুদিন রাত আলো হয়ে দেখা দেয় নি ।

বহুদিন জমে আছে মৃত শ্যাওলা ঘাটের প্রথম সিক্ত ধাপে ,
বহুদিন পথ পিচ্ছিল ছিল স্যাঁতস্যাঁতে সিক্ততায় ।
বহুদিন কথার ঝুড়ি ভরে উঠতে পারেনি নতুন কথার ফুলে,
কারণ পুরোনো কথাগুলো ভাষায় সেজে উঠবার পায়নি অবসর ।

বহুদিন একটা ছোট অশ্বত্থের চারা আঁকড়ে বেঁচে আছে
ঘাটের একটি সরু ভঙ্গুর খাঁজ ,
বহুদিন ধরে ঘাটের সোপান ভেঙেছে জলকেলির তীব্র খেলায় ,
বহুদিন ঘাটের পানিতে তার পা ভিজে নি , সিক্ত এলোচুল গড়িয়ে
জলের কণা আর কারও হাতে, কণ্ঠে সুর তোলেনি ।

এমনি করে বহুদিন ...
তারপর বহুদিন পরে হঠাত বসন্তের এলোজল-হাওয়ার মাতোয়ারায়
ধুয়ে গেল ঘাটের সমস্ত ক্লান্তি, শ্রান্তি আর ধুলো ...
প্রতীক্ষায় না বহুদিনের নিত্যতায় ?

মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০১৩

অনিরুদ্ধের কথা



কথাগুলো জলের মত তরল ছিল না,
অত সহজে অবলীলায় গড়িয়েও যেত না ।
অত সহজে জলের মত আকণ্ঠ পানও করা যেত না ,
মেটাত না বহু উত্তপ্ততার তৃষা ।
অতি দহনের নিদাঘে বাষ্প হয়ে আর্দ্র হৃদয়কে প্রশস্তি দিত না,
আবার মেঘ হয়ে শ্রাবণের বারিধারার মত অনিন্দ্য সুধায় হৃদয়কে স্নাত করবে
তেমনটাও ঘটত না ...
তবে কথাগুলো কি ছিল স্ফটিকের মত ?
বেড়ে উঠছিল বহু দিনের নিভৃত যতনে না জানিয়ে
স্বয়ং বাড়ির মালিককে ...
ছাদের শূন্য চিলেকোঠা অল্পদিনের মধ্যেই যাদুর ফুসমন্তরের মত
ভরে গেল অজস্র ফিসফিস কথা আর কানাকানিতে ...
তারা ছুটে বেড়ায় আকাশের বুকে রঙিন ঘুড়ির মত ,
তাদের কেউ কেউ আকাশে ডানা মেলার সুযোগ পায়;
কেউ বা আবার ভোঁ কাট্টা , ছিন্নসূত্র হয়ে ভেসে বেড়ায় , কেউ বা জড়ায়
গাছের ডালে, রাস্তার তারে বা কোন বাড়ির ছাদে ।
কথার ঘুড়ি হারানোর কষ্ট হয়ত যাবে না সহজে, তবে শীঘ্রই
নতুন ঘুড়ি উড়বে আকাশে কারণ প্রতিটি পুরোনো কথাই আবার জন্ম নিবে নতুন করে,
প্রকৃতির নিয়মে ।

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০১৩

খেলাঘর...তাসের ঘর...নষ্টনীড়...



খেলাঘর ...
ওদের নীলচে দেয়ালের ঘরে জানালা ছিল একটাই, উত্তুরে,
তাতে হয়ত শীতের কনকনে হাওয়া হাড় কাঁপাত ওদের পৌষে,
তবু ভালবাসার উষ্ণতায় উত্তাপ আর আলো ছড়িয়ে থাকত ওদের
ছোট আধো আলো আধো ছায়াময় ঘরটায় ।
এযেন ঠিক ভালবাসাম্য রাজ্যে ঝলসানো রুটিকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পাওয়া ।
বিলাসী চিরন্তন প্রেমমুগ্ধ গোলাপের চারা ছিল না ওদের,
ছিল কেবল ছোট জায়গায় ঘেরা একটি ছোট শুভ্র দোলনচাঁপার চারা ,
যে বেচারা অভাবের পরিসরে হয়ত ছিল কিঞ্চিত রুগ্ণ ; তবু ওদের ভালবাসায়
ও নিত্য সুরভিত হত শুভ্রতায় ।
ওদের ছিল না বিলাসী রেস্টুরেন্টের ডাইনিং হল,
যেটা ছিল একজনের প্রেমময় আবদার আর অন্যজনের অনিন্দ্য উপহার ।
ওরা বের হত বিহারে , জনগণের সড়কে , দিনের রৌদ্র আর রাত্রির ধ্রুবতারার
একই স্বপ্নিল নীল আর পেলব রাতের আকাশকে ভালবেসে ...
ওদের তরী দুলত সকাল -সাঁঝে , দিবস-রজনীতে
সন্ধ্যামালতীর সৌরভে ।

তাসের ঘর ...
ওদের সাদাটে দেয়ালের ঘরে জানালা ছিল একটাই, পশ্চিমা,
তাতে বৈশ্বিক যোগাযোগ আর প্রযুক্তির অজস্র উপাত্ত ঠাই করে নিচ্ছিল
ওদের মাঝে । যেন মানবীয় জীবনে আর সম্পর্কের জৈব- অজৈব , আবেগিক-বাস্তবিক
উপাত্তে কিছু সংখ্যা আর তরঙ্গের উপাত্তের অসূরীয় দূষণ ।
এখন ইট-কাঠের ঘরের বদলে ত্রিমাত্রিক বিম্বময় ভাসমান ঘরের প্রসপেক্টাস
হাতে ঘুরে ওদের দুজনের । আজ পূর্ণিমার চাঁদের থেকে গোলাকার ডিস্কের চকচকে
প্রলেপের ভাজে লুকানো তথ্য ওদের কাছে যেন মানুষকে চেনার, ধরার মাধ্যম ।
ওরা ধরেই নিয়েছে কণ্ঠস্বর মিথ্যা বলে , চোখও মিথ্যা আবেগকে দেখায় ,
সত্য কেবলি ঐ উপাত্তে । তাই সেই আধো আলো আধো ছায়ার ঘর এখন
হুট করেই তাসের ঘর , তাতে সাহেব-বিবি-গোলাম টেক্কা-নহলা-দহলা
সবার যান্ত্রিক অঙ্কিত আবাস । এখন ফ্লুরোসেন্ট বাল্বের আলোই সত্য ,
সূর্য, ধ্রুবতারা আর আকাশের বদলে মহাকাশের স্যাটেলাইটগুলোই গতিতে ঘূর্ণায়মান ,
নয় জড়তায়, স্থবিরতায় ।

নষ্টনীড় ...
ওদের লালচে ঘরের দেয়ালে জানালা একটাই, দখিনা,
তা দিয়ে প্রবেশ করে হয়ত বসন্ত বাতাস বা বসন্ত জীবাণু...
ঘর রুদ্ধ আবাস নয় , তাই বেরিয়ে পড়ে অনেক কিছুই, একই সাথে ঢুকে অনেক কিছুই ।
ত্রিমাত্রিক বিম্বময় ঘরকেও চিরন্তন ভেবে বেঁচে থাকা যায় না , যা ছিল না, যা নেই,
যা থাকবে না ---সেই মরীচিকার সাথে ওরা কেউই থাকবে না হয়ত শেষ পর্যন্ত ।
ঘরে ফেরার নীড় এতদিনে নষ্টনীড় ...সমগ্র শান্তি, সুখের আধার আজ পরিত্যক্ত প্ল্যাটফর্ম ।
অভ্রভেদী হাহাকার আর মর্মভেদী কান্নার জান্তব সুরে জন্ম নিবে কি ?
সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান না কি ......
মর্মন্তুদ জীবন যাপন ?