- মাথার চারপাশে বায়ুর ঘূর্ণি , ধুলো মাথায় দেখছি টেবিলের কোণ থেকে বেরিয়ে আসা আমার ওড়নার লাল-হলুদ সুতো । ও ঘূর্ণিতে উড়ছে কিন্তু উড়ে যেতে পারছে না...... ঘুরছি আমিও কিন্তু বাস্তব বুদ্ধির অভিকর্ষের টানে উড়ে যেতা পারছি না আমিও...... আমার মাথায় এসে বসেছে অগুণিত পাখি, আসছে , উড়ে যাচ্ছে...... আমার মনে পড়ছে রবি'র সেই খাঁচার পাখি আর বনের পাখি......
- খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে বনের পাখি ছিল বনে। একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে। বনের পাখি বলে - 'খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে মিলে।' খাঁচার পাখি বলে - 'বনের পাখি আয় খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।' বনের পাখি বলে - 'না, আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।' খাঁচার পাখি বলে - হায়, আমি কেমনে বনে বাহিরিব!'
- বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি বনের গান ছিল যত, খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার - দোঁহার ভাষা দুইমত। বনের পাখি বলে - 'খাঁচার পাখি ভাই, বনের গান গাও দিখি।' খাঁচার পাখি বলে - 'বনের পাখি ভাই, খাঁচার গান লহো শিখি।' বনের পাখি বলে - 'না, আমি শিখানো গান নাহি চাই।' খাঁচার পাখি বলে - 'হায়, আমি কেমনে বনগান গাই।'
- বনের পাখি বলে - 'আকাশ ঘননীল, কোথাও বাধা নাহি তার।' খাঁচার পাখি বলে - 'খাঁচাটি পরিপাটি কেমন ঢাকা চারি ধার।' বনের পাখি বলে - 'আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে।' খাঁচার পাখি বলে - 'নিরালা সুখকোণে বাধিঁয়া রাখো আপনারে।' বনের পাখি বলে - 'না, সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!' খাঁচার পাখি বলে - 'হায়, মেঘে কোথা বসিবার ঠাঁই!'
- এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে তবুও কাছে নাহি পায়। খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে চায়। দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বুঝাতে নারে আপনায়। দুজনে একা ঝাপটি মরে পাখা কাতরে কহে - 'কাছে আয়!' বনের পাখি বলে - 'না, কবে খাঁচায় রুধি দিব দ্বার।' খাঁচার পাখি বলে - 'হায়,
মোর শকতি নাহি উড়িবার।'
- তারপর...... আজ রাতে...... দুই পাখি ...... আবার মুখোমুখি......... অতঃপর......
নির্বাক ওরা ছিল না কেউই, তবু কথা বলার আয়োজনযেন বাংলা ব্যাকরণের বিপরীত শব্দ দেওয়া- নেওয়ার ছেলেমানুষী খেলা....... চাওয়া দুজনার, না পাওয়াও দুজনার... তবু ছেড়ে যাওয়া হয় না কোন অজ্ঞাত মোহে...ছোঁয়ার বহু দূরে আমৃত্যু অপ্রাপ্তির খুব নিকটে... জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি কোন মন্থর বৃত্তের গণ্ডিতে বাস দুজনার...প্রাপ্তি কেবলই দীর্ঘশ্বাস আর নীরবতার আমৃত্যু অস্পষ্টতা ...আজও অনেক কিছুই বুঝে অনেক কিছু না বোঝার বোঝা......ওদের মাঝের বৃত্তের গতি মন্থর, তাই বলে গতিহীন নয়...ক্রমমন্দনে গতি শুন্যতায় পৌঁছায়নি বরং প্রাপ্তির শূন্যটা সাম্যবাদে বিন্দুকে ঘিরে জন্ম দিয়ে চলে আরও না জানার অগণিত বৃত্তকে আর সেই বৃত্তকে ঘিরে ওদের আজও পরিক্রমণ......একে অন্যকে পাবার কাম আজও অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়নি......সেই অঙ্কুরের ভুক মেটায় না জানি কোন রসদ !!!একজন চায় বন্ধনের বিস্তার আরেক জনে চায় বন্ধনের গভীরতা...কিন্তু তাই বলে বন্ধন গভীরতায় বিস্তৃতি পায় না... কেবলই পারস্পরিক শূন্যতার জটিল গোলক ধাঁধাঁয় পরিক্রমণ করেআজ , কাল , পরশু, সপ্তাহ , মাস, বছর, শতাব্দী ......অতঃপর একই রূপ একইকালীন পরিক্রমণে প্রশ্নবিদ্ধ হয় চোখের বালি ??? অভ্যস্ততায় না জানি কোন চাওয়ায় হেসে চোখের বালিকে উড়িয়ে দেয় স্বয়ং প্রশ্নকর্তা বনের পাখি... খাঁচার পাখিটি নীরব তার আপন অসম্পূর্ণতার চিন্তায়... উত্তর সে খুঁজেও পায়...তবু মুখস্থ বুলি ওর , সহজ কথা পায়না বলতে সহজে......অথচ যা ছিল সবচেয়ে সহজ তাই হল সবচেয়ে কঠিনবন্ধন আর মুক্তির সীমাহীন ব্যুৎপত্তিই জন্ম দিল দুজনার মাঝে অতল নীরব সিন্ধুর ; সিন্ধুর ঘোলা জলের অস্পষ্টতাআর কাটে না অথচ স্পষ্টতা ছিল কাম্য দুজনারই তবু পারস্পরিক অক্ষমতার জের ধরে স্পষ্ট হল না কিছুই এবং তারপর ওরা পাখি দুটো আবদ্ধ হল আজ রাতে কেবল পরিচিতের শিরোনামে...... যা আরেকটি বৃত্তের সীমাবদ্ধ গণ্ডি টেনে দিল দুজনার মাঝে......সেই অগণিত বৃত্তকে মাঝখানে রেখে ওরা অপেক্ষায় প্রহর গোণে পারস্পরিক বৈপরীত্যের সেই ছেলেমানুষী খেলায়...আর হাসেন বিধাতা... এই দুই বিহঙ্গীর প্রহসিত প্রতিজ্ঞায়......